ইসলামী ব্যাংক হোম লোন পদ্ধতি ২০২৫: কি কি লাগবে ও রেট অফ রিটার্ন কত?
ইসলামী ব্যাংক হোম লোন পদ্ধতিতে ভাড়া ক্রয় বা Hire Purchase under Shirkatul Melk (HPSM) পদ্ধতিতে বিনিয়োগ করা হয়। Hire Purchase কে আমরা কিস্তিতে ক্রয়ও বলতে পারি। এখানে সুদভিত্তিক নয় বরং বিনিয়োগ ও মুনাফার ভিত্তিতে অর্থায়ন করা হয়। যারা ইসলামিক নিয়ম মেনে বাড়ি করতে চান, তাদের জন্য এটি একটি কার্যকর সমাধান।

নিজের একটি বাড়ি থাকা আমাদের সবার স্বপ্ন। কিন্তু বাস্তবতা হলো — শহরে কিংবা গ্রামে, জমি কিনে বাড়ি নির্মাণ করতে গেলে দরকার লাখ লাখ টাকা। সাধারণ চাকরিজীবী বা মধ্যবিত্ত পরিবারের পক্ষে একসাথে এত টাকা জোগাড় করা অনেক কঠিন।
তাহলে এখন সমাধান কি? বিস্তারিত জানুন ইসলামী ব্যাংক হোম লোন নিয়ে।
এই ব্লগে আমরা বিস্তারিত জানব Hire Prurchase অনুসোরে ইসলামী ব্যাংকের বিভিন্ন হোম লোন স্কিমসমূহ, ঋণ পাওয়ার শর্তাবলী এবং প্রয়োজনীয় কাগজপত্র নিয়ে।
ইসলামী ব্যাংক হাউজিং ইনভেস্টমেন্ট স্কিমসমূহ
ইসলামী ব্যাংক বর্তমানে কয়েকটি ভিন্ন ভিন্ন হাউজিং ইনভেস্টমেন্ট স্কিম চালু করেছে। প্রত্যেকটি স্কিম আলাদা ধরনের গ্রাহকের জন্য তৈরি করা হয়েছে। আসুন এক নজরে জেনে নিই—
১. Polli Griha Nirman Biniyog Prokalpa (PGNBP)
যাদের গ্রামে বাড়ি করার জন্য ব্যাংক লোন দরকার তারা এই লোনটি নিতে পারেন। সাধারণত গ্রামাঞ্চলের নিম্ন ও মধ্যবিত্ত পরিবারের জন্য এটি কার্যকর। এই স্কিমে স্বল্পসুদৃশ মুনাফার বিনিময়ে দীর্ঘ মেয়াদে কিস্তিতে টাকা পরিশোধ করা যায়।
২. Semi-Pucca Housing Investment Scheme
যারা আধাপাকা ঘর নির্মাণ করতে চান, তাদের জন্য এই স্কিম। বিশেষ করে গ্রামীণ এলাকায় টিনশেড ঘরকে আধাপাকা করার জন্য ইসলামী ব্যাংক এই বিনিয়োগ স্কিম চালু করেছে।
৩. Housing Investment Program (HIP)
শহরাঞ্চলে জমি কিনে ফ্ল্যাট বা পাকা বাড়ি নির্মাণের জন্য এই প্রোগ্রাম। সাধারণত মধ্যবিত্ত ও উচ্চবিত্ত চাকরিজীবী পরিবার এ স্কিম ব্যবহার করতে পারেন। মেয়াদ তুলনামূলক দীর্ঘ এবং কিস্তি সুবিধাজনক।
৪. Housing Investment Programme for Govt. Employees (HIPGE)
সরকারি চাকরিজীবীদের জন্য বিশেষ সুবিধাযুক্ত হাউজিং লোন। এখানে কিস্তি ও মুনাফার হার তুলনামূলক সহজ ও সুবিধাজনক রাখা হয়েছে যাতে চাকরি জীবনের মধ্যে সহজে পরিশোধ করা যায়।
ইসলামী ব্যাংক হোম লোন পদ্ধতি
ইসলামী শরিয়াহ্ভিত্তিক ভাড়া ক্রয় (Hire Purchase) সিস্টেম অনুসারে ইসলামী ব্যাংকের রয়েছে “হাউজিং ইনভেস্টমেন্ট স্কিম” যেগুলোকে আমরা অনেকে ইসলামী ব্যাংক হোম লোন বলে থাকি।
Hire Purchase কে আমরা কিস্তিতে ক্রয়ও বলতে পারি। এখানে সুদভিত্তিক নয় বরং বিনিয়োগ ও মুনাফার ভিত্তিতে অর্থায়ন করা হয়। ফলে যারা ইসলামিক নিয়ম মেনে বাড়ি করতে চান, তাদের জন্য এটি একটি কার্যকর সমাধান।
আপনার বুঝার জন্য সহজ উদাহরণ,
ধরুন, আপনি একটি ঘর নির্মাণ করতে চান যার খরচ ৫০ লাখ টাকা। এখানে ব্যাংক দিবে ৩৫ লক্ষ টাকা এবং আপনি দিবেন ১৫ লক্ষ টাকা। এক্ষেত্রে ব্যাংক এবং আপনি ২জনই বাড়ির মালিক হবেন। আপনি বাড়ি ব্যবহার করবেন এবং ব্যাংকের অংশের জন্য ব্যাংককে মাসিক ভাড়া পরিশোধ করবেন। পাশাপাশি কিস্তিতে মূল টাকা পরিশোধ করে ব্যাংকের অংশ কিনে নিতে থাকবেন। সব টাকা পরিশোধ হয়ে গেলে আপনি বাড়ির পুরো মালিকানা পেয়ে যাবেন।
ইসলামী ব্যাংক হোম লোন কারা পাবে
লোন দেয়ার আগে যে কোন ব্যাংকই চায়, আপনার স্থায়িত্ব, ঋণ পরিশোধের ক্ষমতা এবং দায়িত্বশীলতা। যারা নিয়মিত বেতন বা আয়ের উৎস দেখাতে পারে, তাদের জন্য সুযোগ বেশি। যাইহোক, ইসলামী ব্যাংক হোম লোনের আবেদন যারা করতে পারবেন, তারা হলেন:
- বাংলাদেশি নাগরিক – যারা স্থায়ীভাবে দেশে বসবাস করছেন। অর্থাৎ বিদেশে থাকা বা প্রবাসী নাগরিকরা শুধুমাত্র নির্দিষ্ট স্কিমে (যেমন HIP) আবেদন করতে পারবেন।
- সরকারি ও আধা-সরকারি কর্মচারী – চাকরি স্থায়ী এবং নিয়মিত বেতনপ্রাপ্ত হলে তারা সহজেই আবেদন করতে পারেন।
- শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের শিক্ষক ও কর্মচারী – স্কুল, কলেজ, মাদ্রাসা, বিশ্ববিদ্যালয় বা অন্যান্য শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে যারা চাকরিজীবী, তারা এই স্কিমের সুবিধা নিতে পারবেন।
- ব্যবসায়ী ও পেশাজীবী – যারা নির্দিষ্ট আয়ের উৎস আছে, যেমন ছোট ব্যবসা, বেসরকারি চাকরি, ফ্রীল্যান্স বা পেশাগত সেবা।
- গ্রামীণ এলাকার লোকজন – কৃষক, জেলে, স্থানীয় ব্যবসায়ী বা শ্রমিক যারা পূর্বে ঋণ সঠিকভাবে পরিশোধ করেছেন, তারা PGNBP-এর মাধ্যমে বাড়ি তৈরি বা সংস্কারের জন্য সাহায্য নিতে পারেন।
ইসলামী ব্যাংক হোম লোনের শর্ত
- আবেদনকারীর বয়স – সাধারণভাবে 21 থেকে 65 বছর। বিশেষ ক্ষেত্রে যারা সামাজিকভাবে প্রতিষ্ঠিত, স্থিতিশীল আয়ের অধিকারী এবং সুস্থ শরীরের, তাদের বয়স 70 পর্যন্ত বাড়ানো যেতে পারে।
- লোনের মেয়াদ – স্কিম অনুযায়ী 10 থেকে 20 বছরের মধ্যে। ছোট লোনে মেয়াদ কম, বড় লোনে মেয়াদ বেশি।
- আয় শর্ত – ন্যূনতম মাসিক আয় থাকতে হবে। উদাহরণ: Semi-Pucca Housing স্কিমে ৩০,০০০ টাকা মাসিক আয় থাকা আবশ্যক।
- ব্যাংকের অনুপাত – ব্যাংক সাধারণত 60% থেকে 70% পর্যন্ত বিনিয়োগ করে, বাকি অংশ গ্রাহক নিজেরভাবে দিতে হবে।
- বিনিয়োগ পদ্ধতি – Hire Purchase under Shirkatul Melk পদ্ধতি যাকে ভাড়া ক্রয় বা কিস্তিতে ক্রয় পদ্ধতিও বলা যায়। অর্থাৎ ব্যাংক ও গ্রাহক যৌথভাবে লোনের টাকা বিনিয়োগ করে।
- প্রফিট রেট – সুদ নয়, কিন্তু ব্যাংক নির্ধারিত লাভের হার অনুযায়ী মাসিক কিস্তি পরিশোধ করতে হয়। সাধারণত ৯% বা ব্যাংকের সময়ানুযায়ী হার।
আরও দেখতে পারেন:
ইসলামী ব্যাংক হাউজ লোনের জন্য প্রয়োজনীয় কাগজপত্র
১. জাতীয় পরিচয়পত্র (NID)
আবেদনকারীর পরিচয় নিশ্চিত করার জন্য সর্বপ্রথম প্রয়োজন হবে এনআইডি কার্ড অথাৎ জাতীয় পরিচয় পত্র। বাংলাদেশ ব্যাংকের নিয়ম অনুসারে বয়স, জন্মস্থান বা নাগরিকত্বের তথ্য প্রমাণ করার জন্য একমাত্র এনআইডিই ব্যবহার করা হয়।
২. ছবি (Passport Size)
সাধারণত ২–৩টি সাম্প্রতিক পাসপোর্ট সাইজের ছবি লাগবে। আবেদন ফর্ম, ব্যাংকের রেকর্ড এবং পরিচয়পত্রের সাথে মিলিয়ে রাখা হয়।
৩. আয়ের প্রমাণপত্র
সরকারি কর্মচারী হলে – বেতন বিবরণী বা অফিসের সনদপত্র। বেসরকারি চাকরিজীবীদের জন্য: বেতন বিবরণী, ব্যাংক স্টেটমেন্ট বা চাকরির নিয়োগপত্র। ব্যবসায়ী বা প্রফেশনালদের জন্য: ব্যবসার নিবন্ধন, আয়কর রিটার্ন, এবং ব্যাংক স্টেটমেন্ট।
মূলত এটা দিয়ে ব্যাংক দেখতে চায়, আপনার Stable Income Source আছে কিনা।
৪. জমি / সম্পত্তির বন্ধক
আপনার নিজ নামে কোন সম্পত্তি যেমন জমি প্লট বা বির্ল্ডিং মর্টগেজ রাখতে হবে। এজন্য দরকার হবে সম্পত্তির বৈধ দলিল (খতিয়ান, রেজিস্ট্রেশন)। এছাড়া প্রয়োজন হতে পারে স্থাপনার অনুমোদিত নকশা (যদি নতুন বাড়ি বা ফ্ল্যাট নির্মাণ হয়)।
৫. পরিবারের সদস্যদের স্বাক্ষর ও গ্যারান্টি
সাধারণত স্বামী/স্ত্রী, বড় ছেলে/মেয়ে প্রয়োজনীয় গ্যারান্টি দেবে। ব্যাংক যাতে সম্পত্তি বিক্রি করতে পারবে, যদি লোন মেয়াদে সমস্যা হয়, তার জন্য Personal Guarantee প্রয়োজন।
৬. সরকারি কর্মচারীদের জন্য অতিরিক্ত কাগজপত্র
সরকারি কর্মচারীদের জন্য বাড়তি কিছু কাগজপত্র লাগতে পারে যেমন-
- চাকরির স্থায়ী সনদপত্র।
- নিয়োগপত্র বা বর্তমান পদমর্যাদা প্রমাণপত্র।
- যদি সরকারি স্কিমে আবেদন করেন (HIPGE), তবে আবেদন শুধু স্থায়ী কর্মচারীদের জন্য।
৭. আবেদন ফর্ম
ব্যাংকের নির্দিষ্ট ফর্ম, যা নিকটতম শাখা থেকে সংগ্রহ করতে হয়। ফর্মে নিজের তথ্য, সম্পত্তির বিবরণ, মাসিক আয় এবং প্রয়োজনীয় ডকুমেন্ট সংযুক্ত করতে হয়।
৮. অন্যান্য প্রাসঙ্গিক কাগজপত্র
লোনের জন্য প্রয়োজনীয় অতিরিক্ত দলিল (যেমন ব্যাংক চাহিদা অনুযায়ী পূর্বের ঋণ পরিশোধ রেকর্ড)। স্থানীয় ভূমি অফিস বা পৌরসভা থেকে প্রমাণপত্র (যদি প্রয়োজন হয়)।
ইসলামী ব্যাংক হোম লোনের সুবিধা
ইসলামী ব্যাংকের হোম লোন শুধু বাড়ি তৈরি বা কেনার জন্য নয়, এটি একটি সুদমুক্ত এবং শরীয়াহভিত্তিক সমাধান। নিচে দেখুন এর প্রধান সুবিধাগুলো:
- সুদভিত্তিক নয় – ইসলামী ব্যাংক এবং গ্রাহক যৌথভাবে লাভ ভাগাভাগি বা HPSM পদ্ধতি ব্যবহার করে লোন পরিচালনা করে।
- দীর্ঘ মেয়াদে কিস্তি সুবিধা – স্কিম অনুযায়ী লোন মেয়াদ ১০ থেকে ২০ বছর পর্যন্ত হতে পারে। দীর্ঘ মেয়াদে কিস্তি দেওয়ার সুবিধা থাকায় মাসিক অর্থপরিশোধের বোঝা হালকা হয়।
- ভিন্ন ভিন্ন হাউজিং স্কিম – গ্রাহকের প্রয়োজনীয়তা অনুসারে ভিন্ন ভিন্ন স্কিম রয়েছে।
- সরকারি চাকরীজীবিদের জন্য বিশেষ সুবিধা – HIPGE স্কিমে সরকারি ভর্তুকি সংযুক্ত থাকে। উদাহরণ: ক্লায়েন্ট ৪% + সরকারি ভর্তুকি ৫% → মোট ৯%।
শেষ কথা
ভাড়া ক্রয় বা Hire Purchase এমন একটি ইসলামী শরিয়াহভিত্তিক ঋণ ব্যবস্থা যেখানে গ্রাহক ধাপে ধাপে কিস্তিতে মূল্য পরিশোধ করে কোন সম্পত্তির মালিক হতে পারে। বর্তমানে ফ্ল্যাট, গাড়ি ক্রয় বা বাড়ি নির্মাণ অথবা অন্য কোন স্থায়ী সম্পত্তি ক্রয় করতে পারে।
যারা সুদভিত্তিক লেনদেন করতে চান না, তাদের জন্য বাড়ি নির্মাণের টাকা যোগাড় করতে একটি হালাল, নিরাপদ ও শরিয়াহসম্মত সমাধান হচ্ছে ইসলামী ব্যাংক হোম লোন।