হুন্ডি কি ও হুন্ডি ব্যবসা কিভাবে করে | হুন্ডির মাধ্যমে টাকা পাঠানো হয় কিভাবে
এক দেশ থেকে অন্যদেশে অবৈধভাবে টাকা লেনদেন এবং অবৈধভাবে অর্থ পাচারের মাধ্যম হচ্ছে হুন্ডি। আসুন জানি হুন্ডি কি এবং হুন্ডি কিভাবে কাজ করে।

সারা বিশ্বে প্রচলিত ব্যাংকিং আইন অমান্য করে অবৈধভাবে রেমিট্যান্স এক দেশ থেকে অন্য দেশে লেনদেনের পদ্ধতিই হলো হুন্ডি ব্যবসা এবং যারা এধরণের কাজে লিপ্ত থাকে তাদেরকে বলা হয় হুন্ডি ব্যবসায়ী।
সাধারণত ব্যাংকের তুলনায় অধিক ডলার রেট, সহজ ও দ্রুত হওয়ার কারণে হুন্ডির মাধ্যমে লেনদেন করতে আগ্রহী। তাছাড়া, যারা অবৈধ অভিবাসী তারা নিজ আইডেন্টিটি না থাকার কারণে হুন্ডির মাধ্যমে লেনদেন করতে হয়।
অথচ এই ধরণের লেনদেন বিশ্বের সকল দেশেই অবৈধ ও শাস্তিযোগ্য অপরাধ।
আসুন জানি হুন্ডি ব্যবসা কি এবং এটি কিভাবে কাজ করে।
হুন্ডি ব্যবসা কি
হুন্ডি ব্যবসা হলো এক দেশ থেকে অন্য দেশে লেনদেনের বা রেমিট্যান্স পাঠানোর এক ধরনের অবৈধ উপায়। হুন্ডির মাধ্যমে হুন্ডি এজেন্ট এক দেশে মুদ্রা গ্রহণ করে এবং অন্য দেশে অবস্থানরত তাদের এজেন্টের মাধ্যমে সেই দেশের মুদ্রায় গ্রাহককে পরিশোধ করে। এর ফলে প্রকৃতপক্ষে এক দেশ থেকে অন্য দেশে টাকার আদান প্রদান হয় না।
হুন্ডি ব্যবসায়ীদের বিভিন্ন দেশে অবস্থানরত একটি বিশাল নেটওয়ার্ক গ্রুপ থাকে। এই গ্রুপই কোন দেশ থেকে টাকা নিয়ে অন্য দেশে তাদের গ্রুপের মাধ্যমে টাকা পরিশোধ করে। তাই, এতে বাস্তবিকভাবে মূদ্রার কোন প্রবাহ থাকে না।
হুন্ডি ব্যবসায় সাধারণত বিশ্বের প্রচলিত ব্যাংকিং পদ্ধতি অনুসরণ না করে অনানুষ্ঠানিক ভাবে লেনদেন করা হয় যা বিভিন্ন হুন্ডি ব্যাবসায়ী বা এজেন্টের মাধ্যমে হয়ে থাকে। এটি একটি অনৈতিক ব্যবসা হওয়ায় অধিকাংশ সময় এ ধরনের ব্যবসায়ীরা অবৈধতার মামলায় জড়িয়ে পড়তে পারে।
শুধু বর্তমান যুগেই নয় মুঘোল আমল থেকে ব্রিটিশ আমল পর্যন্ত এই হুন্ডি ব্যবসার পরিচিতি ও জনপ্রিয়তা ছিল অনেক বেশি।
বাংলাদেশে হুন্ডি ব্যবসার একটি বড় ক্ষেত্র হলো প্রবাসীদের দ্বারা পাঠানো রেমিটেন্স এবং এর প্রসারতা দিন দিন বেড়েই চলছে যা অর্থনীতির উপর খুবই নেতিবাচক প্রভাব ফেলছে।
হুন্ডি কিভাবে কাজ করে
এক দেশ থেকে অন্য দেশে অবৈধভাবে লেনদেনের মাধ্যম হলো হুন্ডি এবং যারা এই ব্যবসা করে তারা হলো হুন্ডি ব্যবসায়ী। হুন্ডি ব্যবসায়ীর বিভিন্ন দেশে এজেন্ট থাকে। এসব এজেন্ট বা সহযোগির মাধ্যমেই তারা বিভিন্ন দেশে লেনদেন করে থাকে।
নিচের ছবিতে লক্ষ্য করুন হুন্ডি কিভাবে কাজ করে।

যেভাবে হুন্ডির মাধ্যমে টাকা পাঠানো হয়
ধরা যাক, আপনার বাবা দুবাইয়ে থাকে এবং সেখান থেকে বাংলাদেশে আপনার কাছে ২০ হাজার টাকা পাঠাবে।
আপনার বাবা দুবাইয়ে কোন হুন্ডি এজেন্টের সাথে যোগাযোগ করল, এবং বাংলাদেশে পাঠানোর জন্য ২০ হাজার টাকার সমপরিমাণ মূল্য ৬৭০ দিরহাম পরিশোধ করল। একই সাথে আপনার ব্যাংক একাউন্ট নম্বর দিয়ে দিল।
হুন্ডি এজেন্ট তাদের বাংলাদেশী এজেন্টের মাধ্যমে আপনার ব্যাংক একাউন্ট নম্বরে দিয়ে ২০ হাজার টাকা জমা করে দিল।
খেয়াল করে দেখুন, এতে করে দুবাই থেকে আপনার বাবার দেয়া ৬৭০ দিরহাম বাংলাদেশের কোন ব্যাংক পায়নি। এ লেনদেনটি যদি ব্যাংকের মাধ্যমে হতো তাহলে বাংলাদেশের ব্যাংক বৈদেশিক মুদ্রা উপার্জন করতে পারত। কিন্তু হুন্ডি ব্যবসায়ীর মাধ্যমে অবৈধভাবে এই লেনদেনটি করায় দেশের অর্থনীতিতে নেতিবাচক প্রভাব পড়ল।
বর্তমানে অনলাইনেই এ ধরনের ব্যবসা করা হচ্ছে এবং দিন দিন অনলাইনে এর প্রসারতা বেড়েই চলছে।
আরও পড়ুন: ব্যাংকে টাকা রাখা কি হারাম?
হুন্ডি ব্যবসা কিভাবে করে
হুন্ডি ব্যবসায়ীর বিভিন্ন দেশে এজেন্ট থাকে। আমেরিকায় অবস্থানরত এজেন্ট সেই দেশে গ্রাহকের কাছ থেকে ডলার সংগ্রহ করে অন্যদিকে বাংলাদেশে অবস্থিত এজেন্ট গ্রাহকের পরিবারের কাছে টাকা পৌছে দেয়। একইভাবে, বাংলাদেশের হুন্ডি এজেন্ট টাকা সংগ্রহ করে, আমেরিকার এজেন্ট টাকার পরিবর্তে ডলার তার ব্যাংক বা পরিবারকে পৌছে দেয়।
ধরুন, বাংলাদেশি হুন্ডি এজেন্ট একজন ব্যক্তির থেকে বিদেশে টাকা পাঠানোর জন্য প্রতি ডলার ১২০ টাকা করে নিল, কিন্তু বিদেশ থেকে কেউ বাংলাদেশে টাকা পাঠানোর ক্ষেত্রে তাকে প্রতি ডলার ১১৫ টাকা করে দিল। এক্ষেত্রে তা প্রতি ডলারে ৫ টাকা মুনাফা হলো। এভাবেই হুন্ডি ব্যবসার মুনাফা অর্জিত হয়।
হুন্ডি ব্যবসায়ীরা মূলত ব্যাংকের নির্ধারিত ডলার রেট থেকে গ্রাহকদের বেশি রেট নিয়ে থাকে ও দিয়ে থাকে। এছাড়া কোন রকম ঝামেলা ছাড়াই বিনা খরচেই ও কম সময়ে টাকা লেনদেন করে থাকে।
আজকাল হুন্ডি ব্যবসায়ীরা ক্রিপ্টোকারেন্সির ব্যবহার করেও খুবই গোপনীয়তার মাধ্যমে টাকা লেনদেন করে থাকে।
তবে ক্রিপ্টোকারেন্সির মাধ্যমে এই ব্যবসায় নিরাপত্তা সংক্রান্ত ঝুঁকি থাকায় এই পদ্ধতি এখনো তেমন জনপ্রিয়তা পায়নি এবং এই পদ্ধতি এখনো তেমন কার্যকর নয়।
আবার বিভিন্ন আর্থিক প্রতিষ্ঠানের অসাধু কর্মচারীরাও আজকাল অবৈধভাবে টাকা লেনদেনের ব্যবস্থা করে থাকে এবং এভাবে বিভিন্ন আর্থিক প্রতিষ্ঠানে কর্মরত থাকার পরেও তারা হুন্ডি ব্যবসায় জড়িয়ে পড়ছে।
এরকম বিভিন্ন পদ্ধতি অবলম্বন করে ইদানিং হুন্ডি ব্যবসার প্রসারতা বৃদ্ধি পাচ্ছে এবং বিভিন্ন দেশের অর্থনৈতিক অবস্থাকে ধ্বংসের দিকে ঠেলে দিচ্ছে।
হুন্ডি ব্যবসা কি হালাল?
না, টাকা লেনদেনের ক্ষেত্রে হুন্ডি ব্যবসা গ্রাহকদের খুব ভালো সুযোগ সুবিধা দিলেও অবৈধ উপায়ে এই ব্যবসা করা হয় বলে হুন্ডি হালাল নয় বরং হারাম ব্যবসা।
ব্যাংকের মাধ্যমে রেমিটেন্স বা বাণিজ্যিক মুদ্রা লেনদেন করলে ব্যাংক একটি নির্দিষ্ট হারে সমপরিমাণ টাকা দিয়ে দেয় এবং এর ফলে উক্ত দেশ বেশ কিছু বৈদেশিক মুদ্রা অর্জন করতে পারে যা একটি রাষ্ট্রের অর্থনীতিতে বিশেষ ভূমিকা পালন করে।
অপরদিকে হুন্ডি ব্যবসার ফলে একটি দেশের বৈদেশিক মুদ্রা উপার্জনের হার কমে যায় যা সেই দেশের অর্থনীতিতে নেতিবাচক প্রভাব ফেলে।
হুন্ডি ব্যবসা বাংলাদেশহ পৃথিবীর প্রায় সকল দেশেই নিষিদ্ধ এবং এই নিষিদ্ধ ব্যবসা দ্বারা বিভিন্ন অবৈধ কাজের প্রসারতা বৃদ্ধি পাচ্ছে যা একটি রাষ্ট্রের অর্থনৈতিক অবস্থাকে ধ্বংস করে দেওয়ার জন্য যথেষ্ঠ।
হুন্ডি ব্যবসা সম্পূর্ণ অনৈতিকভাবে অবৈধ উপায় করা হয় যা চোরা চালানোর মতো বড় বড় কাজের সুযোগ বৃদ্ধি করছে তাই যদি ইসলামী শরীয়ত অনুযায়ী এটি অবৈধ ব্যবসা নাও হয় তবুও একটি রাষ্ট্রের জন্য ক্ষতিকারক বলে এটি কখনো হালাল হবে না।
হুন্ডি ব্যবসা সম্পূর্ণ হালাল নাকি হারাম তা আমাদের অজানা হলেও যেহেতু এটি সমাজ ও রাষ্ট্রের জন্য একটি ক্ষতিকারক এবং অবৈধ ব্যবসা তাই আমাদের উচিত এ ধরনের ব্যবসাকে হালাল মনে না করা এবং হুন্ডি ব্যবসায়ীদের নির্মূল করা।
হুন্ডির শাস্তি কি?
হুন্ডি ব্যবসা পৃথিবীর প্রায় সকল দেশেই নিষিদ্ধ কারণ এটি অবৈধভাবে টাকা পাচার সংক্রান্ত একটি বিষয়।
কোন ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠান যদি হুন্ডি ব্যবসার সাথে জড়িত থাকে তবে হুন্ডি ব্যবসার সাথে জড়িত সকল ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠানকে আইনের আওতায় এনে মানিলন্ডারিং অপরাধী হিসেবে শাস্তি দেওয়ার নির্দেশনা রয়েছে।
মানিলন্ডারিং আইনে এ ধরনের অপরাধের দুই ধরনের শাস্তি হয়ে থাকে তা হলো:
- মানি লন্ডারিং অপরাধের সাথে সম্পর্কিত প্রতিষ্ঠানের ক্ষেত্রে এই অপরাধের সাথে সংশ্লিষ্ট অর্থ বা সম্পত্তির মূল্যের সমপরিমাণ বা সর্বোচ্চ ২০ লক্ষ টাকা অর্থদণ্ডের সাথে প্রতিষ্ঠানের নিবন্ধন বাতিল করা হবে।
- মানি লন্ডারিং অপরাধের সাথে সম্পর্কিত ব্যক্তি এবং সহযোগীদের ক্ষেত্রে ন্যূনতম ৪ বছর এবং অনধিক ১২ বছর পর্যন্ত কারাদন্ড এর পাশাপাশি অপরাধের সাথে সংশ্লিষ্ট সম্পত্তির দ্বিগুণ পরিমাণ অর্থ বা সর্বোচ্চ ১০ লক্ষ টাকা পর্যন্ত অর্থদণ্ড হবে।
- আদালত থেকে দন্ডিত ব্যক্তির সম্পত্তি রাষ্ট্রের অনুকূলে প্রত্যক্ষ এবং পরোক্ষভাবে বাজেয়াপ্ত করার আদেশ দিতে পারবে।
- অপরাধী বা দণ্ডিত ব্যক্তি যদি এ সকল আইন বা আদেশ লঙ্ঘন করে তাহলে তাকে অনধিক ৩ বছরের কারাদণ্ড এবং আদেশকৃত সম্পত্তির মূল্যের সমপরিমাণ অর্থদণ্ডে দণ্ডিত করা হবে।
হুন্ডি ব্যবসা মানি লন্ডারিং অপরাধের অন্তর্ভুক্ত হওয়ায় কোন ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠান যদি হুন্ডি ব্যবসা করার ফলে আইনের আওতায় আসে তবে উপরোক্ত শাস্তি গুলো তার জন্য প্রযোজ্য হবে।
শেষ কথা
হুন্ডি ব্যবসা বিশ্বব্যাপী একটি নিষিদ্ধ এবং অবৈধ ব্যবসা যা যেকোনো রাষ্ট্রের অর্থনীতিতে নেতিবাচক প্রভাব ফেলার পাশাপাশি অর্থনৈতিক অবস্থাকে ধ্বংস করে দিতে পারে।
হুন্ডির মাধ্যমে অবৈধভাবে টাকা লেনদেনের ফলে বিভিন্ন দেশে চোরা চালানের মত বড় বড় অপরাধের সৃষ্টি হচ্ছে যা আইনি নিয়ন্ত্রণে আনা উচিত এবং এই ধরনের ব্যবসায়ীদের ন্যায্য শাস্তি দেওয়া উচিত।
ভাই একটা বিষয় ক্লিয়ার করার ছিল, বিদেশ থেকে এজেন্ট এর মাধ্যমে পাঠানো টাকা দেশের এজেন্টের মাধ্যমে পরিবারের নিকট পৌছানো হয়, ফলে
বাস্তবিকভাবে মূদ্রার কোন প্রবাহ থাকে না।
,,কথা হলো দেশের এজেন্ট গুলো কিভাবে টাকা কালেক্ট করে??
সুন্দর প্রশ্ন করেছেন, ধন্যবাদ।
যখন বাংলাদেশ থেকে কোন পন্য বিদেশে রপ্তানী করা হয়, তার বিপরীতে বৈদেশিক মুদ্রা দেশে আসার কথা। কিন্তু সেখানে রপ্তানী মূল্য কম দেখিয়ে দেশে, কম টাকা আনা হয়, বাকি টাকা ওই দেশে থেকে যায়। এসব হুন্ডি ব্যবসায়ীদের সাথে আমদানি রপ্তানিকারক ও চোরাকারবারীদের সাথে হাত থাকে।
রপ্তানীমূল্য কম দেখানো, আমদানী মুল্য বেশি দেখানো, স্বর্ণ চোরাচালানের মাধ্যমে, বিদেশের এজেন্টরা এই টাকা পায়।