মৃত ব্যক্তির ব্যাংক ঋণ পরিশোধ করার নিয়ম

অনেকেই ব্যাংক থেকে ব্যক্তিগত ঋণ নিয়ে থাকেন। ঋণ পরিশোধ না করে মারা গেলে, মৃত ব্যক্তির ঋণ কে পরিশোধ করবে ঋণ পরিশোধ করার নিয়ম নিয়ে বিস্তারিত।

মৃত ব্যক্তির ব্যাংক ঋণ পরিশোধ করার নিয়ম
Advertisement

বাংলাদেশে  ঋণ আদালত আইন, ২০০৩ অনুযায়ী – মৃত ব্যক্তির ঋণ পরিশোধ করার জন্য কতগুলো নীতিমালা রয়েছে। সেই নীতিমালা অনুযায়ী মৃত ব্যক্তির ঋণ পরিশোধ করা হয়ে থাকে।

এই আর্টিকেলে মৃত ব্যক্তির ব্যাংক ঋণ পরিশোধ করার নিয়ম অথবা নীতিমালা সম্পর্কে বিস্তারিত জানব।

সাধারণত কোন ব্যক্তি ঋণ নিয়ে মারা গেলে, ঋণের দায় তার উত্তরাধিকারীদের উপর বর্তায়। তবে মৃত ব্যক্তির উত্তরাধিকারীর কাছ থেকে ঋণের টাকা আদায় করা সম্ভব না হলে, ঋণের সময় জামানত রাখা সম্পদ থেকে ঋণ পরিশোধের চেষ্টা করা হয়।

মৃত ব্যক্তির ব্যাংক ঋণ পরিশোধের নিয়ম

মৃত ব্যক্তির ব্যাংক ঋণ পরিশোধের জন্য প্রথমে ব্যাংকের সাথে যোগাযোগ করে প্রয়োজনীয় কাগজপত্র এবং ঋণের পরিশোধ্য স্থিতি বা ব্যালেন্স জেনে নিতে হবে। এরপর কাগজপত্র জমা দিয়ে, লোন সম্পূর্ণ পরিশোধ বা কিস্তিতে পরিশোধ যেভাবে সম্ভব হয় জমা দিতে হবে।

ব্যাংক ঋণ নিয়ে আরও তথ্য:

নিচে মৃত ব্যক্তির লোন পরিশোধ করার ধাপগুলো আলোচনা করা হলো।

ধাপ ১: প্রয়োজনীয় ডকুমেন্ট সংগ্রহ

মৃত্যু নিবন্ধন: মৃত্যুর পর মৃত ব্যক্তির মৃত্যু সনদ সংগ্রহ করতে হবে এবং সেটি ইউনিয়ন পরিষদ থেকে সংগ্রহ করা যাবে। এজন্য, মৃত ব্যক্তির জন্ম নিবন্ধন নাম্বার দিয়ে অনলাইনে মৃত্যু নিবন্ধনের আবেদন করতে হবে।

Advertisement

উত্তরাধিকার সনদ: মৃত্যু নিবন্ধনের পর মৃত ব্যক্তির সম্পত্তির উপর আইনি অধিকার প্রতিষ্ঠার জন্য স্থানীয় পৌরসভা অথবা ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান এর কাছ থেকে উত্তরাধিকার সনদ সংগ্রহ করতে পারেন। এটি দেওয়ানী আদালতের মাধ্যমেও পাওয়া যায়।

ব্যাংকের সাথে যোগাযোগ: মৃত ব্যক্তির ব্যাংক ঋণ পরিশোধের জন্য আরও কি কি কাগজপত্র লাগবে, এ সম্পর্কে সংশ্লিষ্ট ব্যংকের সাথে যোগাযোগ করে বাকি কাগজপত্র সংগ্রহ করতে হবে।

ধাপ ২:ঋণ পরিশোধের আবেদন

মৃত ব্যক্তির  ব্যাংক ঋণ পরিশোধের জন্য ব্যাংক থেকে প্রয়োজনীয় ফরম পূরণ করে কাগজপত্র সহ জমা দিতে হবে।

ব্যাংকে প্রয়োজনীয় কাগজপত্র:

Advertisement
  • মৃত্যু সনদ
  • উত্তরাধিকার সনদ
  • পরিচয় প্রমাণ (যেমন: জাতীয় পরিচয়পত্র)
  • ঋণের কাগজপত্র (যেমন: ঋণ চুক্তি, স্টেটমেন্ট)

ধাপ ৩: ঋণ পরিশোধ 

  • ব্যাংকের সাথে আলোচনা: সাধারণত নগদ বা চেকের মাধ্যমে ঋণ একাউন্টে টাকা জমা দিয়ে ঋণ পরিশোধ করা হয়। তারপরও কখন ও কিভাবে ঋণ পরিশোধ করবেন এ বিষয়ে ব্যাংক কর্তৃপক্ষের সাথে আলোচনা করা যায়।
  • নিয়মিত কিস্তি পরিশোধ: কিস্তিতে পরিশোধযোগ্য হলে ঋণের টাকা কিস্তিতে জমা দিয়ে সম্পূর্ণ পরিশোধ করা যাবে, বা সম্ভব হলে সম্পূর্ণ ঋণ এককালীণ পরিশোধ করা যাবে।

মৃত ব্যক্তির ঋণ পরিশোধের উপায় সমূহ

কোন ব্যক্তি ঋণ রেখে মারা গেলে বেশ কয়েকটি মাধ্যমে ব্যাংক তার ঋণ আদায় করতে পারে ।যেমন-

  • বন্ধকৃত সম্পত্তি: যদি ঋণ দেওয়ার সময় কোন সম্পত্তি বন্ধক রাখা হয় তবে সে বন্ধকৃত সম্পত্তি থেকে মৃত ব্যক্তির ঋণের টাকা পরিশোধ করা যায়।
  • উত্তরাধিকার: মৃত ব্যাক্তি সন্তান সন্ততিরা তার বকেয়া ঋণ পরিশোধ করতে পারে। মৃত ব্যক্তির উত্তরাধিকারীরা সম্পত্তির অনুপাতে ঋণের দায়িত্বের ভাগ করে নিতে পারে।
  • যৌথ ঋণ: যৌথ ভাবে ঋণ নেওয়ার ক্ষেত্রে মৃত ব্যক্তির সহযোগী ব্যক্তিকে ঋণ পরিশোধ করতে হবে।
  • ব্যাংক একাউন্টে: ঋণ গ্রহণকারী মৃত ব্যক্তির যদি কোন ব্যাংক একাউন্টে টাকা জমা থাকে। তবে সেখান থেকে ঋণের টাকা আদায় করার চেষ্টা করা হয়।
  • বীমা: ঋণের বীমা থাকলে, ঋণের বকেয়া অংশ বীমা কোম্পানিকে পরিশোধ করতে হতে পারে।
  • ব্যাংক থেকে ঋণ নিয়ে যে সম্পদ তৈরি করা হয়েছে যে সম্পদ বিক্রি করে টাকা পরিশোধ করা যেতে পারে।
  • হাদিস অনুযায়ী: যদি ঋণগ্রস্ত মৃতের কোনো সম্পদ না থাকে এবং তাঁর স্ত্রী-সন্তানেরাও তা শোধ করতে সক্ষম না হয় বা না করে, তবে সমাজ, সংগঠন বা সরকার সেই দায়িত্ব বহন করবে। (বুখারি: ২২৯৮) 

মৃত ব্যক্তির ব্যাংক ঋণ পরিশোধ সম্পর্কিত পরামর্শ

  • ঋণগ্রস্ত কোন ব্যক্তি মারা যাওয়ার পর অবশ্যই যে ব্যাংক থেকে ঋণ নেওয়া হয়েছে সে ব্যাংকের সাথে যত দ্রুত সম্ভব যোগাযোগ করে ঋণ শোধ করতে হবে। কেননা, ব্যাংকের সুদ কিন্তু প্রতিনিয়ত বেড়েই চলেছে।
  • ঋণ কিভাবে পরিশোধ করা হবে তা নিয়ে ব্যাংকের সাথে আলোচনা করতে হবে। কেননা যদি ঋণ পরিশোধ করার সামর্থ্য না থাকে তাহলে সে বিষয়টি তুলে ধরে ব্যাংকের নিকট ঋণ মওকুফের জন্য আবেদন করা যেতে পারে।
  • আর যদি ঋণ পরিশোধের সামর্থ্য থাকে,  তাহলে ঋণ পরিশোধের সময়সীমা বৃদ্ধির বিষয়টি নিয়ে আলোচনা করা যেতে পারে।
  • ঋণ পরিশোধের ব্যাপারে কোন জটিলতা সৃষ্টি হলে একজন আইনজীবীর সাথে যোগাযোগ করতে পারেন।

মৃত ব্যক্তির ব্যাংক লোন মওকুফ

ঋণের পরিমাণ, মৃত ব্যক্তির উত্তরাধিকারীদের আর্থিক অবস্থা এবং ব্যাংকের নীতিমালার উপর মৃত ব্যক্তির ব্যাংক ঋণ মওকুফ করার বিষয়টি নির্ভর করে।

Advertisement

১. উত্তরাধিকারীদের আর্থিক অবস্থা:

যদি উত্তরাধিকারী ঋণ পরিশোধ করতে সক্ষম হয়: তবে, ব্যাংক ঋণের বকেয়া অংশ পরিশোধের জন্য উত্তরাধিকারীদের সাথে যোগাযোগ করবে। উত্তরাধিকারীরা ঋণ পরিশোধ করতে সম্মত হলে, ব্যাংক তাদের সাথে পুনরায় ঋণ প্রদানের চুক্তি করবে। এক্ষেত্রে ঋণ মওকুফ করা হবে না । 

যদি উত্তরাধিকারী ঋণ পরিশোধ করতে অক্ষম হয়: এই ক্ষেত্রে, ব্যাংক মৃত ব্যক্তির সম্পত্তি থেকে ঋণ আদায়ের চেষ্টা করতে পারে। কিন্তু যদি মৃত ব্যক্তির পর্যাপ্ত সম্পত্তি না থাকে, তাহলে ব্যাংক ঋণের বকেয়া অংশ মওকুফ করতে পারে।

২. ঋণের পরিমাণ

 ঋণ আদালত আইন, ২০০৩ অনুযায়ী

  •  যদি ঋণ আদায়ের কোন উপায় না থাকে এবং মৃত ব্যক্তির নামে ৫ লক্ষ টাকা পর্যন্ত ঋণ নিয়ে থাকে। তাহলে ব্যাংক নিজস্ব বিবেচনায় ঋণ মামলা দায়ের করা ছাড়াই মওকুফ করতে পারে ।
  • ৫ লক্ষ টাকার বেশি ঋণের ক্ষেত্রে, ব্যাংক সাধারণত আইনি পদক্ষেপ গ্রহণ করে ঋণ আদায়ের চেষ্টা করে।

৩. ব্যাংকের নীতিমালা:

  • বিভিন্ন ব্যাংকের মৃত ব্যক্তির ঋণ পরিশোধের জন্য ভিন্ন ভিন্ন নীতিমালা থাকতে পারে। মৃত ব্যক্তির উত্তরাধিকারিদের ঋণ পরিশোধের পদ্ধতি সম্পর্কে জানতে, সংশ্লিষ্ট ব্যাংকের সাথে যোগাযোগ করা উচিত।

ব্যাংক লোন মওকুফের আবেদন 

অনেক সময় আসলের থেকে সুদ অনেক বেশি হয়ে যায় বা আর্থিক দুরবস্থার কারণে সুদসহ ঋণ পরিশোধ করা সম্ভব হয় না । সেক্ষেত্রে ঋণের জন্য সুদ মওকুফের জন্য আবেদন করা যায়।

ব্যাংক ঋণের সুদ মওকুফ করার জন্য অনেকগুলো নীতিমালা রয়েছে। নীতিমালা গুলো বিস্তারিত বিস্তারিতভাবে জানতে ও বুঝতে নিচের pdf টি পড়তে পারেন।

সুদ মওকুফ সম্পর্কিত নীতিমালা:

https://www.bb.org.bd/mediaroom/circulars/brpd/apr212022brpd06.pdf

পিডিএফটি তে অনেকগুলো নীতিমালা রয়েছে। তার মধ্যে সবথেকে গুরুত্বপূর্ণ নীতিমালা হলো- 

ঋণ গ্রহীতার মৃত্যু অথবা প্রাকৃতিক দুর্যোগ, মহামারী, মড়ক, নদী ভাঙ্গন বা দুর্দশাজনিত কারণে ক্ষতিগ্রস্থ ঋণগ্রহীতা ঋণ পরিশোধ করতে না পারলে ঋণ মওকুফ করে দেওয়া হয়।

তাই মৃত ব্যক্তির বকেয়া ঋণ পরিশোধ করতে তার পরিবারের অতিরিক্ত সমস্যা হলে ঋণের সুদ মওকুফ করার জন্য আবেদন করতে পারে। 

ব্যাংক ঋণ পরিশোধ না করার শাস্তি

সময়মত ঋণ পরিশোধন না করলে ঋণ টি খেলাপি ঋণ হিসেবে সাব্যস্ত হয়। ঋণ খেলাপি হলে আদালতে মামলা করা হতে পারে যেটি একটি দীর্ঘমেয়াদী সমস্যা হয়ে দাঁড়াবে।

ঋণ খেলাপি হলে আপনি বিভিন্ন আইনগত জটিলতায় পড়তে পারেন। বিস্তারিত জানতে দেখুন ব্যাংক ঋণ পরিশোধ না করার শাস্তি

ঋণের পরিমাণ বেশি হলে আদালত ঋণগ্রহীতার বিদেশ ভ্রমণে নিষেধাজ্ঞা জারি করতে পারে। এছাড়া, ঋণের পরিমাণ অনেক বেশি হলে ঋণ আদায়ের জন্য ঋণ গ্রহীতার সম্পত্তি বাজেয়াপ্ত  করা হয়ে থাকে।

আশা করি এই আর্টিকেলটি পড়ার মাধ্যমে মৃত ব্যক্তির ব্যাংক ঋণ পরিশোধ করার নিয়ম সম্পর্কে স্পষ্ট ধারণা পেয়েছেন।

Similar Posts

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *