মুশারাকা কি, মুশারাকা পদ্ধতিতে কিভাবে ব্যবসা করে?
মুশারাকা ইসলামী অর্থনীতি অনুযায়ী অংশীদারিত্বমূলক ব্যবসার চুক্তি, যেখানে একাধিক ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠান যৌথভাবে মূলধন ও শ্রম বিনিয়োগ করে ব্যবসা করে এবং লাভ-লোকসান ভাগ করে নেয়।

ইসলামী অর্থনীতির কথা উঠলেই একটা শব্দ প্রায়ই শোনা যায়— মুশারাকা। কিন্তু মুশারাকা আসলে কী? মুশারাকা কত প্রকার এবং মুশারাকা পদ্ধতিতে কিভাবে ব্যবসা করে এসব বিষয়ে বিস্তারিত আলোচনা করবো।
মুশারাকা ইসলামী অর্থনীতির একটি গুরুত্বপূর্ণ অংশ যেখাবে পারস্পরিক অংশীদারিত্বের ভিত্তিতে ব্যবসা পরিচালিত হয়। এ পদ্ধতিতে একাধিক ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠান যৌথভাবে মূলধন বিনিয়োগ করে এবং লাভ-ক্ষতির অংশীদার হয়। ইসলামী ব্যাংকিং ও অর্থব্যবস্থায় মুশারাকা একটি জনপ্রিয় মডেল, যা সুদমুক্ত ব্যবসার সুযোগ তৈরি করে।
মুশারাকার মত আরেকটি ইসলামী বিনিয়োগ ব্যবস্থা হচ্ছে মুদারাবা। তবে মুদারাবা ও মুশারাকার পার্থক্য রয়েছে।
এই আর্টিকেলে আমরা মুশারাকার সহজ ব্যাখ্যা দেব, যাতে তুমি সহজেই বুঝতে পারো এবং প্রয়োজনে নিজের ব্যবসায় প্রয়োগ করতে পারো।
মুশারাকা কি
মুশারাকা একটি ইসলামিক ব্যবসার ধরণ যেখানে একাধিক পক্ষ মিলিতভাবে মূলধন যোগান দেয়, ব্যবসা পরিচালনা করে এবং অর্জিত লাভ বা ক্ষতি পূর্বনির্ধারিত অনুপাতে বণ্টন করে। এই ধরণের ব্যবসায়কে অংশীদারী ব্যবসা বলা হয়।
মুশারাকা পদ্ধতিতে
- লাভ ভাগ হবে পূর্বনির্ধারিত চুক্তি অনুযায়ী।
- ক্ষতি ভাগ হবে মূলধনের অনুপাতে।
অর্থাৎ, আপনি যদি ৪০% মুলধন বিনিয়োগ করেন, আর তোমার বন্ধু ৬০% বিনিয়োগ করে, তাহলে লাভ ভাগ করা যাবে বিনিয়োগের পরিমাণ, দায়িত্ব পালন, শ্রম ও অন্যান্য শর্তে উপর ভিত্তি করে। তবে ক্ষতি হলে সবাই তার বিনিয়োগ অনুপাত অনুযায়ী দায় নেবে।
মুশারাকা অর্থ কি?
মুশারাকা শব্দটি আরবি “شراكة” (Shirkah) শব্দ থেকে এসেছে, যার অর্থ অংশীদারিত্ব।
মুশারাকা কত প্রকার
মুশারাকা সাধারণত দুই ধরনের হয়—
স্থায়ী মুশারাকা (Permanent Musharakah)
এটা এমন একটা অংশীদারিত্ব, যেখানে বিনিয়োগ স্থায়ীভাবে থাকে। মানে, একসঙ্গে একটা ব্যবসা শুরু করলে সেটা দীর্ঘমেয়াদি চলতে থাকবে, এবং কেউ চাইলে নিজের শেয়ার বিক্রি করে দিতে পারবে।
উদাহরণ: একটা বড় ব্যবসা (যেমন— কোম্পানি) যেখানে বিনিয়োগকারীরা শেয়ারহোল্ডার হয়ে থাকেন।
অস্থায়ী মুশারাকা (Diminishing Musharakah)
এখানে ব্যবসা বা বিনিয়োগ একটা নির্দিষ্ট সময়ের জন্য হয়, এবং এক পক্ষ ধীরে ধীরে আরেক পক্ষের শেয়ার কিনে নেয়।
উদাহরণ: ইসলামী ব্যাংক যখন কাউকে বিনিয়োগ দেয়, তখন সময়ের সাথে সাথে ব্যবসায়ী ব্যাংকের অংশ কিনে নেয় এবং একসময় সম্পূর্ণ মালিক হয়ে যায়।
মুশারাকা পদ্ধতিতে ব্যবসার নিয়ম
মুশারাকা পদ্ধতিতে ব্যবসার মূল নিয়ম হলো, একাধিক অংশীদার যৌথভাবে মূলধন বিনিয়োগ করবে। মূলধন বিনিয়োগে সবাই সমপরিমাণ মূলধন বিনিয়োগ করতে হবে তা বাধ্যতামূলক নয়। লাভ বন্টনের ক্ষেত্রে পূর্বনির্ধারিত চুক্তি অনুযায়ী লাভ ভাগ করে নেয়, তবে ক্ষতি মূলধনের অনুপাতে বহন করতে হয়।
সব অংশীদার ব্যবসার সিদ্ধান্ত গ্রহণ ও পরিচালনায় সক্রিয় ভূমিকা রাখে। তবে কেউ বেশি দ্বায়িত্ব পালন করলেও তার বিষয়ে চুক্তিতে সকল অংশীদার সম্মত হতে হবে। এছাড়া ব্যবসার লেনদেন সুদ (Riba) ছাড়া ইসলামী শরিয়াহ অনুযায়ী পরিচালিত হয়।
অর্থাৎ মুশারাকা পদ্ধতির মূলনীতিগুলো হচ্ছে:
- যৌথ মূলধন: সকল অংশীদার মিলে বিনিয়োগ করবে। সকল অংশীদারের বিনিয়োগের পরিমাণ নির্ণয় করে চুক্তিতে উল্লেখ করতে হবে।
- লাভ-ক্ষতির ভাগ: সবাই চুক্তি অনুযায়ী লাভ ভাগ করবে, কিন্তু ক্ষতি হবে মূলধনের অনুপাতে।
- সিদ্ধান্ত গ্রহণ: সব অংশীদার ব্যবসার সিদ্ধান্ত নেওয়ার ক্ষেত্রে ভূমিকা রাখবে।
- পরিচালনা: ব্যবসার পরিচালনা ও ব্যবস্থাপনা অংশীদাররা যৌথভাবে করতে পারে বা সকলের সম্মতিক্রমে একক ব্যক্তির উপর দায়িত্ব অর্পণ করা যেতে পারে।
- সুদের (Riba) কোনো জায়গা নেই: সুদ ছাড়া ব্যবসা চলবে, ইসলামী শরিয়াহ অনুযায়ী।
মুশাকারা পদ্ধতির উদাহরণ
একজন বিনিয়োগকারী শুধুমাত্র অর্থ বিনিয়োগ করবে এবং অন্যজন তার কৃষিজমি, শ্রম, ও আনুষঙ্গিক ব্যয় নির্বাহ করে কোন খামার বা কৃষি উৎপাদন করতে যাচ্ছে। এখানে ২ জনই এখানে কিছু না কিছু বিনিয়োগ করছে, একজন টাকা অন্যজন জমি, শ্রম ও অন্যান্য ব্যয়।
মোট বিনিয়োগের পরিমাণ নির্ধারণ: এক্ষেত্রে উভয়ের প্রকৃত বিনিয়োগের পরিমাণ নির্ণয় করে নিতে হবে। অর্থাৎ ১ম জনের বিনিয়োগকৃত টাকার পাশাপাশি, ২য় জনের জমি ব্যবহারের ভাড়ামুল্য, তার শ্রম ও অন্যান্য ব্যয়ের মূল্যও নির্ধারণ করতে হবে। উভয় মূল্যই হবে ব্যবসায়ের মোট বিনিয়োগের পরিমাণ।
লাভ বন্টন: মুশারাকা পদ্ধতিতে লাভ বন্টনের জন্য, আলোচনা ও চুক্তির ভিত্তিতে নির্ধারিত হবে।
লোকসান বন্টন: ব্যবসাতে লস হলে মোট বিনিয়োগের পরিমাণ অনুপাতে উভয়কে লোকসান গ্রহণ করতে হবে। ধরি, ১ম বিনিয়োগকারী ৩,০০,০০০ লক্ষ টাকা দিল এবং ২য় বিনিয়োগকারীর জমির ভাড়া মুল্য, শ্রম ও অন্যান্য ব্যয় বাবদ ২ লক্ষ টাকা হলো। সুতরাং তাদের লোকসান বন্টনের অনুপাত হবে ৩:২। মোট লোকসানকে ৫ ভাগ করে ১ম জন ৩ ভাগ ও ২য় জন ২ ভাগ লোকসান নিবে।
এই বিষয়ে মুফতি সাইদুজ্জামান কাসেমি’র একটি প্রশ্নের উত্তর দেখতে পারেন এখানে মুশারাকা ব্যবসার নিয়ম।
বিভিন্ন ধরণের ব্যবসায় মুশারাকা পদ্ধতিতে পরিচালনা করা যায়। উদাহরণস্বরূপ রয়েছে নিচের খাতগুলো:
ইসলামী ব্যাংকিং: ব্যাংক এবং ব্যবসায়ী মিলে বিনিয়োগ করে, লাভ-ক্ষতি ভাগ করে। যদিও ইসলামী ব্যাংকিংয়ে বিনিয়োগের অন্যান্য মুড ও রয়েছে, তার মধ্যে মুশারাকা অন্যতম।
স্টার্টআপ: কয়েকজন মিলে ব্যবসা শুরু করলে তারা মুশারাকা চুক্তির মাধ্যমে মূলধন দেয় এবং লাভ-ক্ষতি ভাগ করে নেয়।
রিয়েল এস্টেট: কেউ মুশারাকা পদ্ধতিতে বাড়ি বানাতে পারে, যেখানে একাধিক ব্যক্তি যৌথভাবে বিনিয়োগ করতে পারে।
মুশারাকার সুবিধা ও অসুবিধা
মুশারাকার সুবিধাসমূহ
- সুদমুক্ত বিনিয়োগ পদ্ধতি।
- ব্যবসার ঝুঁকি সবার মধ্যে ভাগ হয়ে যায়।
- ইসলামী নীতির সাথে সামঞ্জস্যপূর্ণ।
- অংশীদারদের মধ্যে স্বচ্ছতা থাকে।
মুশারাকার অসুবিধাসমূহ
- সব সময় উপযুক্ত ও বিশ্বস্ত অংশীদার খুঁজে পাওয়া কঠিন।
- ব্যবসার নিয়ন্ত্রণ নিয়ে মতপার্থক্য হতে পারে।
- সব দেশে মুশারাকার আইনগত কাঠামো নেই।
ইসলামী দৃষ্টিকোণে মুশারাকা
কুরআনে বলা হয়েছে:
“হে ঈমানদারগণ! তোমরা পরস্পরের সম্পদ অন্যায়ভাবে ভক্ষণ করো না, তবে পরস্পরের সম্মতিতে ব্যবসা-বাণিজ্য হলে তা বৈধ।” (সূরা আন-নিসা: ২৯)
হাদিস:
নবী (সা.) বলেছেন, “আল্লাহ বলেছেন, আমি অংশীদারিত্বের তৃতীয় অংশীদার, যতক্ষণ না একজন অপরজনকে ধোঁকা দেয়।”
অর্থাৎ, মুশারাকা করলে সততা ও স্বচ্ছতা বজায় রাখা খুব জরুরি!
শেষকথা
মুশারাকা হল ইসলামী অর্থনীতির অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ ব্যবসায়িক পদ্ধতি, যেখানে সুদের কোনো স্থান নেই। এটি ন্যায়সঙ্গত এবং ঝুঁকিহীন অর্থনীতির ভিত্তি গড়ে তোলে।
বর্তমানে ইসলামী ব্যাংকিং এবং স্টার্টআপ ফান্ডিংয়ে মুশারাকার জনপ্রিয়তা বাড়ছে। ভবিষ্যতে আরও বেশি মানুষ এই পদ্ধতি অনুসরণ করলে সুদমুক্ত ও ন্যায়নিষ্ঠ অর্থনীতি গড়ে উঠবে ইনশাআল্লাহ!
যদি আপনি সুদমুক্ত, ন্যায়সঙ্গত এবং শরিয়াহ সম্মতভাবে ব্যবসা করতে চান, তাহলে মুশারাকা হতে পারে দারুণ একটা সমাধান।