প্রবাসী কল্যাণ ব্যাংক লোনের নিয়ম ও আবেদন প্রক্রিয়া ২০২৪
আপনি কি প্রবাসী কল্যাণ ব্যাংক থেকে লোন নেয়ার কথা ভাবছেন? আসুন জেনে নিই, প্রবাসী কল্যাণ ব্যাংক লোন নেয়ার নিয়ম, লোনের সুবিধা, কি কি কাগজ লাগে ও আবেদন করার নিয়ম সম্পর্কে।
সাধারণত বিদেশগামী ও প্রবাসীদের আর্থিকভাবে সহযোগিতা করার লক্ষ্যে কিছু বিশেষ সুযোগ-সুবিধা সহ প্রবাসী কল্যাণ ব্যাংক থেকে সহজ শর্তে প্রবাসী লোন দেয়া হয় যা প্রবাসী কল্যাণ ব্যাংক লোন হিসেবে পরিচিত।
আজকে আমরা প্রবাসী কল্যাণ ব্যাংক লোন কি, লোন নিতে কি কি লাগে, কিভাবে লোন নিতে হবে, এর সুযোগ সুবিধা কি এ সকল বিষয় সম্পর্কে বিস্তারিত ভাবে জানবো।
প্রবাসী কল্যাণ ব্যাংক লোন
প্রবাসী কল্যাণ ব্যাংক থেকে বিদেশগামী বা প্রবাসীরা কিছু নির্দিষ্ট শর্তে জামানত ছাড়া বা জামানত সহ স্বল্প সুদে ঋণ নিতে পারেন। প্রবাসী কল্যাণ ব্যাংক লোন সাধারণত চার ধরনের হয়ে থাকে এগুলো হলো অভিবাসন ঋণ , পুনর্বাসন ঋণ, বঙ্গবন্ধু অভিবাসী বৃহৎ পরিবার ঋণ ও বিশেষ পুনর্বাসন ঋণ।
১. অভিবাসন ঋণ
বাংলাদেশ থেকে বিদেশগামী কর্মীদের সহজ শর্তে জামানতবিহীন যে ঋণ বা লোন দেয়া হয় সেটিই হলো অভিবাসন ঋণ। এক্ষেত্রে ২ থেকে ৩ বছরের মেয়াদে সর্বোচ্চ ৩ লক্ষ টাকা পর্যন্ত লোন বা ঋণ দেয়া হয় যার সুদের হার ৯%।
ঋণের সীমা | ৩ লক্ষ টাকা |
ঋণের মেয়াদ | নতুন ভিসার ক্ষেত্রে ৩ বছর; রি এন্ট্রি ভিসার ক্ষেত্রে ২ বছর; |
কিস্তির ধরণ | মাসিক কিস্তি |
সুদের হার | ৯% |
আরও পড়তে পারেন:
২. পুনর্বাসন ঋণ
বাংলাদেশ থেকে কোনো নাগরিক চাকরি বা কাজের উদ্দেশ্যে প্রবাসে গমন করার পর বিভিন্ন সামাজিক বা রাজনৈতিক অরাজকতা অথবা হয়রানির শিকার হয়ে যদি দেশে ফিরে আসে এবং নিজে স্বাবলম্বী হওয়ার জন্য লোন নিতে চায় তাহলে প্রবাসী কল্যাণ ব্যাংক থেকে তাকে পুনর্বাসন ঋণ দেয়া হয়।
এক্ষেত্রে জামানত ছাড়া সর্বোচ্চ ৩ লক্ষ টাকা এবং জামানত সহ সর্বোচ্চ ৫ লক্ষ টাকা পর্যন্ত লোন নেয়া যাবে তবে ৫ লক্ষ টাকার বেশি লোন নিতে হলে অবশ্যই ঋণগ্রহীতা এবং গ্যারান্টারের মালিকানাধীন জমি বা সম্পদের রেজিস্ট্রি ব্যাংকের কাছে দায়বদ্ধ থাকবে।
ঋণের সীমা | ৫০ লক্ষ টাকা |
ঋণের মেয়াদ | সর্বোচ্চ ১০ বছর |
কিস্তির ধরণ | মাসিক কিস্তি |
সুদের হার | ৯% |
আরও পড়তে পারেন:
৩. বঙ্গবন্ধু অভিবাসী বৃহৎ পরিবার ঋণ
বাংলাদেশ থেকে বৈধভাবে চাকরির উদ্দেশ্যে প্রবাসে গমন করার পর বা প্রবাস থেকে ফিরে আসার পর সেই প্রবাসীর উপর নির্ভরশীল পরিবারের সদস্য যেমন বাবা-মা ,স্বামী স্ত্রী, সন্তান , ভাই-বোন কে প্রবাসী কল্যাণ ব্যাংক থেকে সহজ শর্তে বঙ্গবন্ধু অভিবাসী বৃহৎ পরিবার ঋণ প্রদান করা হয়।
এক্ষেত্রে সর্বোচ্চ ৫০ লক্ষ টাকার ঋণ নেয়া যাবে তবে জামানত ছাড়া সর্বোচ্চ ৩ লক্ষ টাকা এবং জামানত সহ সর্বোচ্চ ৫ লক্ষ টাকা পর্যন্ত লোন নেয়া যাবে এবং ৫ লক্ষ টাকার বেশি লোন নিতে হলে অবশ্যই ঋণগ্রহীতা এবং গ্যারান্টারের মালিকানাধীন জমি বা সম্পদের রেজিস্ট্রি ব্যাংকের কাছে দায়বদ্ধ থাকবে।
ঋণের সীমা | ৫০ লক্ষ টাকা |
ঋণের মেয়াদ | সর্বোচ্চ ১০ বছর |
কিস্তির ধরণ | মাসিক কিস্তি |
সুদের হার | পুরুষ ৯%; মহিলা ৭% |
প্রবাসী কল্যাণ ব্যাংক লোন নিতে কি কি কাগজ লাগে
প্রবাসী কল্যাণ ব্যাংক সাধারণত ৪টি স্কিমে প্রবাসীদের লোন দিয়ে থাকে এবং প্রতিটি লোনের ক্ষেত্রেই কিছু প্রয়োজনীয় কাগজপত্র বা ডকুমেন্টস এর প্রয়োজন হয়।
তাহলে চলুন জেনে নেয়া যাক প্রবাসী কল্যাণ ব্যাংক লোন নিতে কি কি লাগে সে সম্পর্কে বিস্তারিত কিছু তথ্য।
অভিবাসন ঋণ
প্রবাসী কল্যাণ ব্যাংক থেকে অভিবাসন ঋণ নিতে হলে যে সকল কাগহপত্র লাগবে:
- ঋণের আবেদন ফরম;
- আবেদনকারীর এনআইডি কার্ডের ফটোকপি;
- আবেদনকারীর নাগরিক সনদ (ইউপি বা পৌরসভা থেকে)
- ছবি ৪ কপি (পাসপোর্ট সাইজ);
- পাসপোর্ট ও ভিসার ফটোকপি;
- ম্যানপাওয়ার স্মার্ট কার্ডের ফটোকপি;
- লেবার কন্ট্রাক্ট পেপার (যদি থাকে);
- জামিনদারদের ছবি ১ কপি (২ জন জামিনদার)
- জামিনদারদের এনআইডি কার্ড ও নাগরিক সনদের কপি;
- যেকোনো একজন জামিনদারের স্বাক্ষর করা ব্যাংকের ৩টি ব্ল্যাংক চেকের পাতা;
- অত্র ব্যাংকে আবেদনকারীর একাউন্ট থাকতে হবে;
পুনর্বাসন ঋণ
পুনর্বাসন ঋণ নিতে হলে যে সকল ডকুমেন্টস লাগবে:
- ঋণের আবেদন ফরম;
- ছবি ৩ কপি
- পাসপোর্ট ও এনআইডি কার্ডের ফটোকপি;
- নাগরিক সনদ বা চেয়ারম্যান সার্টিফিকেট
- জামিনদার এর ২ কপি ছবি, জাতীয় পরিচয় পত্র এবং নাগরিক সনদের কপি।
- ট্রেড লাইসেন্স এর ফটোকপি;
- ব্যবসা বা প্রকল্পের ঠিকানা, বিস্তারিত বিবরণ ও ২ বছরের আয়-ব্যয় বিবরণী;
- বিদেশ থেকে ফিরে আসার সকল ধরনের প্রয়োজনীয় কাগজপত্রের ফটোকপি;
- আবেদনকারীর ব্যবসা বা প্রকল্পে বিনিয়োগের প্রমাণপত্র;
- জামানতি সম্পত্তির কাগজপত্রের ফটোকপি;
- আবেদনকারী ট্রেনিং বা অভিজ্ঞতার সনদের কপি;
- আবেদনকারীর স্বাক্ষর করা ব্যাংকের ৩টি চেকের পাতা।
বঙ্গবন্ধু অভিবাসী বৃহৎ পরিবার ঋণ
বঙ্গবন্ধু অভিবাসী বৃহৎ পরিবার ঋণ নিতে হলে যে সকল ডকুমেন্টস লাগবে:
- ঋণের আবেদন ফরম;
- ৩ কপি ছবি, পাসপোর্ট ও এনআইডি কার্ডের ফটোকপি;
- নাগরিক সনদ পত্র;
- জামিনদার এর ২ কপি ছবি, এনআইডি কার্ডের কপি ও নাগরিক সনদ;
- ট্রেড লাইসেন্স এর কপি;
- ব্যবসা বা প্রকল্পের ঠিকানা, বিস্তারিত বিবরণ ও ১ বছরের আয়-ব্যয় বিবরণী;
- আবেদনকারীর ট্রেনিং বা অভিজ্ঞতার সার্টিফিকেটের কপি;
- প্রবাসী ব্যাক্তি বিদেশে আছে বা বিদেশ থেকে প্রত্যাগমনের প্রমাণপত্র।
প্রবাসী কল্যাণ ব্যাংক লোন নেওয়ার নিয়ম
প্রবাসী কল্যাণ ব্যাংক থেকে লোন নেওয়ার জন্য ঋণের সকল শর্ত অবশ্যই পূরণ করতে হবে। এর পর নিকটস্থ প্রবাসী কল্যাণ ব্যাংকের শাখায় যোগাযোগ করে প্রথমে শাখায় একটি সঞ্চয়ী হিসাব খুলতে হবে। তারপর প্রয়োজনীয় কাগজপত্রসহ লোনের আবেদন ফরম পূরণ করে জমা দিতে হবে।
ঋণ আবেদন অনুমোদনের পর, ঋণের টাকা সঞ্চয়ী হিসাবে জমা হবে এবং আপনি টাকা উত্তোলন করতে পারবেন।
চলুন তাহলে প্রবাসী কল্যাণ ব্যাংক লোন আবেদনের নিয়ম ধাপে ধাপে বিস্তারিত ভাবে জেনে নেয়া যাক।
ধাপ ১ – প্রবাসী কল্যাণ ব্যাংকে যোগাযোগ করুন
প্রবাসী কল্যাণ ব্যাংক থেকে লোন নেওয়ার জন্য প্রথমে আপনাকে প্রবাসী কল্যাণ ব্যাংকের প্রধান কার্যালয়ে যেয়ে স্থানীয় কর্মকর্তাদের সাথে লোন নেয়ার ব্যাপারে যোগাযোগ করতে হবে।
লোন নেওয়ার জন্য যোগাযোগ করার পর ব্যাংক থেকে আপনাকে একটি কাগজ দেয়া হবে যেখানে লোনের ধরন, কি কি ডকুমেন্টস লাগবে, কি কি শর্ত পূরণ করতে হবে, সুদের হার কত, পরিশোধের সময় ইত্যাদি সকল ধরনের যাবতীয় তথ্য গুলো দেয়া থাকবে।
এই কাগজের সকল তথ্য অনুযায়ী সঠিক ডকুমেন্টস নিয়ে পরবর্তীতে লোনের জন্য আবেদন করতে ব্যাংকে যেতে হবে।
ধাপ ২ – লোনের জন্য আবেদন করুন
লোনের জন্য ব্যাংকে যোগাযোগ করার পর নির্ধারিত সকল ডকুমেন্টস নিয়ে আবার ব্যাংকে যেতে হবে এবং প্রবাসী কল্যাণ ব্যাংক লোনের আবেদন ফরম সংগ্রহ করতে হবে।
আবেদন ফরমে উল্লেখিত আপনার সকল তথ্য সঠিক এবং নির্ভুলভাবে দিয়ে আবেদন ফরম পূরণ করতে হবে এবং ব্যাংকে জমা দিতে হবে।
আবেদন ফরম পূরণ করার পর ব্যাংক থেকে লোনের জন্য নির্ধারিত সকল প্রয়োজনীয় কাগজপত্র বা ডকুমেন্টস জমা দিতে হবে।
এক্ষেত্রে আপনার সকল প্রয়োজনীয় কাগজপত্র সম্পূর্ণ সঠিক ও নির্ভুল হতে হবে এবং মনে রাখতে হবে দ্রুত লোন পেতে হলে অবশ্যই আপনাকে সঠিক ও নির্ভুল কাগজপত্র জমা দিতে হবে।
ধাপ ৩ – অনুমোদনের জন্য অপেক্ষা করুন
সঠিকভাবে পূরণকৃত আবেদন ফরম এবং সকল প্রয়োজনীয় কাগজপত্র জমা দেওয়ার পর লোনের অনুমোদন পাওয়ার জন্য আপনাকে অপেক্ষা করতে হবে।
ব্যাংক থেকে আপনার সকল ডকুমেন্টস যাচাই বাছাই করার পর সকল তথ্য সঠিক ও নির্ভুল হলে ৩ দিনের মধ্যেই আপনি লোনের অনুমোদন পেয়ে যাবেন।
তবে কাগজপত্রে কোনো ধরনের সমস্যা থাকলে প্রবাসী কল্যাণী ব্যাংক লোন পেতে সর্বোচ্চ ৭ দিনও সময় লাগতে পারে।
ধাপ ৪ – লোনের টাকা সংগ্রহ করুন
আপনার লোনের আবেদন অনুমোদিত হলে সএমএসের মাধ্যমে আপনাকে জানিয়ে দেয়া হবে। আবেদন অনুমোদনের পরই আপনি লোনের টাকা সংগ্রহ করতে পারবেন। লোনের টাকা সংগ্রহ করার জন্য অবশ্যই আপনাকে ব্যাংকে যেতে হবে এবং প্রয়োজনীয় তথ্য দিয়ে লোনের টাকা সংগ্রহ করতে হবে।
প্রবাসী কল্যাণ ব্যাংক লোনের সুবিধা
প্রবাসী কল্যাণ ব্যাংক লোনের সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য সুবিধাগুলো হচ্ছে:
- বিদেশগামী ও প্রবাসীদের সহজ শর্তে ঋণ;
- সুদের হার ৪-৯% যা অন্যান্য ব্যাংকের তুলনায় খুবই কম;
- জামানতসহ এবং জামানতবিহীন লোন পাওয়া যায়;
- মাত্র ৩ দিনের মধ্যেই লোন পাওয়া যায়;
- লোন পরিশোধের সময়সীমা অন্যান্য ব্যাংকের তুলনায় বেশি (৩-১০ বছর);
- সর্বনিম্ন ৩ লক্ষ টাকা থেকে সর্বোচ্চ ৫০ লক্ষ টাকা পর্যন্ত লোন পাওয়া যায়;
- প্রসেসিং ফি, ডকুমেন্টস ফি, সার্ভিস চার্জ তুলনামূলক কম;
প্রবাসী কল্যাণ ব্যাংক ঋণ সম্পর্কিত সাধারণ প্রশ্ন
শেষ কথা
বিদেশগামী ও প্রবাসীদের সুযোগ-সুবিধার কথা চিন্তা করে প্রবাসী কল্যাণ ব্যাংক নির্দিষ্ট কিছু সহজ শর্তে অন্যান্য ব্যাংকের তুলনায় অনেক বেশি পরিমাণে লোন দিয়ে থাকে যা প্রবাসীদের আর্থিকভাবে সহায়তা করতে সক্ষম।
তাই আর্থিক সহায়তার জন্য প্রবাসী কল্যাণ ব্যাংক থেকে লোন নেয়া বিদেশগামী ও প্রবাসীদের জন্য অধিক শ্রেয়।