যাকাত কাকে বলে ও যাকাত কাদের উপর ফরজ
যাকাত শব্দের অর্থ হচ্ছে পরিশুদ্ধ করা। জানুন যাকাত কাকে বলে, নিসাব কি এবং যাকাত কাদের উপর ফরজ তা নিয়ে বিস্তারিত আলোচনা।
যাকাত আরবি শব্দ যার অর্থ পরিশুদ্ধ করা। ইসলামী পরিভাষায় নির্দিষ্ট পরিমাণ অর্থ-সম্পদের উপর নিসাব পরিমাণ অর্থ বা সম্পদ দান করাই হল যাকাত। চলুন জেনে নেওয়া যাক Zakat প্রদান করতে হলে যাকাত কাদের উপর ফরজ ও যাকাত (Zakat) প্রদানের নিয়ম।
যাকাত কাকে বলে – What is Zakat
পূর্ণবয়স্ক সকল মুসলিম নারী-পুরুষের ব্যক্তিগত সম্পদের একটি নির্দিষ্ট অংশ প্রতিবছর ইসলামী শরিয়াত অনুযায়ী কিছু নিয়ম-কানুন মেনে, সম্পদ বা অর্থ দান করাই হল যাকাত। এতে সম্পদের পবিত্রতা বজায় থাকে। তবে নির্দিষ্ট পরিমাণের থেকে বেশি অর্থ সম্পদের অধিকারী হলে যাকাত প্রদান করতে হয়।
যাকাত হচ্ছে সুদের সম্পূর্ণ বিপরীত। যাকাত ধনী গরীবের ব্যবধান দূর করে অন্যদিকে সুদ ধনীকে আরো ধনী আর গরীবকে আরো গরীব করে ব্যবধান বাড়ায়।
যাকাতের গুরুত্ব অনেক বেশি। পবিত্র কুরআনে নামাজের পর সবচেয়ে বেশিবার উল্লেখ করা হয়েছে যাকাত (Zakat) শব্দটি। কুরআনে যাকাত শব্দটি ৩২ বার উল্লেখ করা হয়েছে।
আরও পড়ুন:
যাকাত শব্দের অর্থ কি?
যাকাত একটি আরবি শব্দ। পারিভাষিক অর্থে বলা যায় যাকাত অর্থ পবিত্রতা, পরিশুদ্ধতা, বৃদ্ধি পাওয়া ইত্যাদি। যাকাত ইসলামের ৫টি মূল স্তম্ভের মধ্যে একটি, পবিত্র কোরআনে সালাতের পরে যাকাতের কথা উল্লেখিত রয়েছে।
নিসাব কাকে বলে?
নিসাব একটি আরবি শব্দ যার অর্থ হচ্ছে নির্ধারিত পরিমাণ। ইসলামী পারিভাষায় নিসাব হচ্ছে যাকাত ফরজ হওয়ার জন্য নির্ধারিত পরিমাণ অর্থ-সম্পদ। নিসাব পরিমাণ সম্পদ হচ্ছে ৭.৫ তোলা বা ৮৭.৪৫ গ্রামের বেশি স্বর্ণ, ৫২.৫ তোলা বা ৬১২.৩৫ গ্রামের বেশি রুপা। গবাদি পশু সম্পদ হলে, ৪০টি ছাগল, ৩০টি গরু, ৫টি উট।
ফসলের মধ্যে ধান, গম, যব সেঁচের পানি ছাড়া বৃষ্টির পানিতে ফলানো হলে বছরের খাদ্য সংরক্ষণ করে অতিরিক্ত যা থাকে তার দশ ভাগের এক ভাগ যাকাত (Zakat) দিতে হবে।
সুতরাং বলা যায় উপরোক্ত স্বর্ণ-রুপা, গবাদি পশু ও ফসলের মধ্যে হিসাব গুলো বজায় রেখে যাকাত প্রদান করাই হলো যাকাতের নিসাব বা পরিমাণ।
যাকাত কাদের উপর ফরজ?
কোন ব্যক্তির জীবনযাপন ব্যয় ও ঋণ বাদে ৭.৫ তোলা স্বর্ণ বা ৫২.৫ তোলা রূপার সমমূল্যের আর্থিক সম্পদ ১ বছর মালিকানায় থাকলে তার উপর যাকাত ফরজ। আবার কোন ব্যক্তির ৪০টির ওপরে ছাগল বা ভেড়া, ৩০টির ওপরে গরু-মহিষ এবং ৫টির বেশি উট থাকলেও তার উপর যাকাত ফরজ হবে।
ইসলামী শরীয়াতের পাঁচটি স্তম্ভের মধ্যে হজ্ব ও যাকাত দুইটি স্তম্ভ হওয়া সত্বেও সবার উপর এগুলো ফরজ নয়। শুধুমাত্র অর্থবানদের জন্য ফরজ।
যাকাত ফরজ হওয়ার শর্ত কয়টি
যাকাত ফরজ হওয়ার শর্ত ৭টি। একজন ব্যক্তির উপর যাকাত ফরজ হওয়ার জন্য যেসব শর্ত রয়েছে তা হলো,
- ইসলাম ধর্মের অনুসারী হতে হবে
- প্রাপ্তবয়স্ক ও বিবেক বুদ্ধিমান হতে হবে
- নিসাব পরিমাণ সম্পদ থাকা
- সম্পদের উপর পরিপূর্ণ মালিকানা থাকতে হবে
- সম্পদের মালিকানা পূর্ণ একবছর অতিবাহিত হওয়া
- স্বাধীন হওয়া
- ঋণ মুক্ত থাকা
বর্তমানে কত টাকা থাকলে যাকাত ফরজ হয়?
দৈনন্দিন ও জীবনযাপন ব্যয় মেটানোর পর বছর শেষে বর্তমানে ৫৯,০০০ টাকা থাকলে যাকাত ফরজ হয়। জীবনযাপন ব্যয় মেটানোর পর অবশিষ্ট আর্থিক সম্পদ ও ব্যবসায়িক পন্যের মূল্য ৭.৫ তোলা বা ৮৭.৪৫ গ্রাম স্বর্ণ অথবা ৫২.৫ তোলা বা ৬১২.৩৫ গ্রামের বর্তমান মূল্যের সমান বা বেশি হলে আপনার উপর যাকাত ফরজ হয়।
যাকাত ফরজ হলে মোট সম্পদের ৪০ ভাগের ১ ভাগ অথবা ২.৫% হারে যাকাত দিতে হবে।
আপনার উপর যাকাত ফরজ কিনা তা জানতে বর্তমান স্বর্ণ বা রুপার দাম জেনে হিসাব করতে হবে। বাংলাদেশ জুয়েলারি সমিতির ঘোষিত দাম অনুসারে বর্তমানে রূপার সর্বনিম্ন মূল্য হচ্ছে প্রতি তোলা ১২২৫ টাকা এবং ৫২.৫ তোলার দাম ৫৯,০৬৩ টাকা। তাই, মোটামুটি ৫৯ হাজার টাকা মূল্যের আর্থিক সম্পদ ও পন্য থাকলে যাকাত ফরজ হবে।
এছাড়া স্বর্ণের দাম অনুসারেও যাকাতের নিসাবের মূল্য হিসাব করতে পারেন যদি স্বর্ণ থাকে স্বর্ণের বর্তমান মূল্য হিসাব করে যাকাত পরিশোধ করতে পারেন। বর্তমানে ১ ভরি স্বর্ণের সর্বনিম্ন মূল্য ৭১,৩৬০ টাকা (১৮ ক্যারেট)। সেই হিসেবে ৭.৫ ভরি বা ৮৭.৪৫ গ্রাম স্বর্ণের মূল্য ৫,৩৫,১৯৫ টাকা।
১ লক্ষ টাকার যাকাত কত ২০২৩
১ লক্ষ টাকায় যাকাত ২৫০০ টাকা প্রদান করতে হবে যেহেতু যাকাতের হার হচ্ছে ২.৫% অর্থাৎ শতকরা ২.৫ টাকা।
যাকাত প্রদানের খাতসমূহ (Who will get Zakat)
যেসব খাতে যাকাতের অর্থ দান করা যাবে এমন খাত হচ্ছে মোট ৮টি। আল্লাহ তা‘আলা পবিত্র কুরআন মাজীদে যাকাত প্রদানের ৮টি খাত উল্লেখ করেছেন। তিনি বলেন,
নিশ্চয়ই ছাদাক্বাহ্ (যাকাত) হচ্ছে ফকীর ও মিসকীনদের জন্য এবং এতে নিয়োজিত কর্মচারীদের জন্য, আর যাদের অন্তর আকৃষ্ট করতে হয় তাদের জন্য; (তা বণ্টন করা যায়) দাস আযাদ করার ক্ষেত্রে, ঋণগ্রস্তদের মধ্যে, আল্লাহর রাস্তায় এবং মুসাফিরদের মধ্যে। এটি আল্লাহর পক্ষ হতে নির্ধারিত, আর আল্লাহ মহাজ্ঞানী, প্রজ্ঞাময়।
(তওবা ৯/৬০)
যাকাতের খাতসমূহ নিচে সংক্ষেপে শেয়ার করা হলো।
- ফকির– ফকির হচ্ছে নিঃসম্বল ভিক্ষাপ্রার্থী যাকে আল্লাহ তা‘আলা যাকাতের ৮টি খাতের প্রথমেই উল্লেখ করেছেন।
- মিসকিন– মিসকীনদের কাছে বছরের অর্ধেক বা তার চেয়ে কম সময় জীবন ধারণ করার মত অর্থ থাকে তাই পুরো বছর চলার মত যাকাত প্রদান করে সহায়তা করা উচিত।
- যাকাত আদায়কারী ও হেফাজতকারী– যারা যাকাত আদায় ও বন্টনের কার্য প্রক্রিয়া পরিচালনা ও হিসাব লিপিবদ্ধ করেন তাদের এক প্রকার যাকাতের উপর হক থাকে।
- নওমুসলিম ও অমুসলিম– ইসলামের প্রতি আকৃষ্ট করার লক্ষ্যে অথবা কোন অনিষ্ট বা কাফেরের ক্ষতি থেকে রক্ষা পাওয়ার লক্ষ্যে কোন নওমুসলিম ও অমুসলিমকে যাকাতের অর্থ প্রদান করা যায়।
- ক্রীতদাস বা বন্দি মুক্ত করার জন্য
- ঋণগ্রস্ত ব্যক্তি– ঋণগ্রস্ত ব্যক্তিকে তার ঋণ থেকে মুক্ত করার লক্ষ্যে যাকাত প্রদান করা যাবে
- আল্লার রাস্তায় ও মুজাহিদ– আল্লাহর দ্বীনকে সমুন্নত করা ও প্রচারের জন্য যাকাতের অর্থ খরচ করা যাবে।
- মুসাফির– সফররত ব্যক্তির খাদ্য ও বাড়ী পর্যন্ত পৌছানোর জন্য যাকাতের অর্থ দান করা যাবে। মুসাফির সম্পদশালী হলেও যাকাত দেয়া যাবে।
যাকাতের খাতসমূহ নিয়ে আরও বিস্তারিত জানতে পড়ুন- যাকাত প্রদানের খাত কয়টি
শেষ কথা
প্রত্যেক মুসলিমের নির্দিষ্ট পরিমান অংশ থেকে যাকাত প্রদান করা উচিত। যাকাত (Zakat) প্রদানের মাধ্যমে সম্পদ এবং জানমাল পবিত্র ও সুরক্ষিত থাকে। পবিত্র কোরআন ও হাদিস শরীফে বিশেষভাবে যাকাত প্রদান ও আদায় করার কথা বলা হয়েছে।