জেনে নিন ইসলামে ব্যবসা করার নিয়ম

ইসলামে ব্যবসা করার নিয়ম মেনে ব্যবসা পরিচাল করলেই সেই ব্যবসা হবে হালাল। হালাল উপার্জন করা একটি ইবাদত। জানুন ইসলামে ব্যবসা করার নিয়ম ও নীতি সম্পর্কে।

Advertisement

ব্যবসার অস্তিত্ব সর্বত্রই বিদ্যমান। এই ব্লগে আমরা জানার চেষ্টা করব ব্যবসা কী? ইসলামে ব্যবসার গুরুত্ব, ব্যবসা হালাল হওয়ার শর্ত, ইসলামে ব্যবসা করার নিয়ম ও নীতিমালা, ইসলামে যৌথ ব্যবসা করার নিয়ম ও ইসলামে নিষিদ্ধ ব্যবসা সম্পর্কে।

আসুন প্রথমেই সংক্ষেপে জেনে নিই, ব্যবসা কি।

মুনাফা অর্জনের উদ্দেশ্যে বৈধ পন্য উৎপাদন, ক্রয়-বিক্রয়, লেনদেন সহ সকল বৈধ অর্থনৈতিক কর্মকান্ডই ব্যবসা। আমরা জানি যে কোন ব্যবসা পন্যদ্রব্য বা সেবাকর্মকে ঘিরেই হয়। মানুষের চাহিদা, পন্য ও সেবা, ক্রয়-বিক্রয়, ঝুঁকি, লেনদেন ও মুনাফা অর্জনের মুখ্য উদ্দেশ্যই ব্যবসার সাধারন বৈশিষ্ট্য।

Advertisement

ইসলামে ব্যবসার গুরুত্ব (Importance of Business in Islam)

পৃথিবীতে জীবিকা অর্জনের জন্য মানুষকে কোন কর্মে লিপ্ত হতে হয়। আর ফরজ ইবাদত গুলোর পর ইসলামে ব্যবসা করার নিয়ম মেনে হালাল রুজি অন্বেষণ করাও একটি ইবাদত। যে ব্যক্তি হারাম উপার্জন ভক্ষণ করে তার ইবাদত কবুল হয়না।

কর্মের মধ্যে ব্যবসা হচ্ছে সবচেয়ে উত্তম এবং মহানবী হযরত মুহাম্মদ (সাঃ) – ব্যবসা করতেন। ব্যবসা সম্পর্কে তিনি বলেন- ‘কোন মানুষ এর চেয়ে উত্তম উপার্জন খায়নি যা সে নিজের হাতে উপার্জন করল।’ আর বৈধ পন্যের ব্যবসা হলো নিজের হাতের সবচেয়ে উত্তম উপার্জন।

Advertisement

পৃথিবীতে ইসলামের খেদমতে বহু নবী-রাসূলগন আগমন করেছেন। তারা প্রত্যেকেই কোন না কোন ব্যবসা করেছেন। হজরত আদম (আঃ) কৃষিকাজ করতেন, হজরত ইদ্রিস (আঃ) কাপড় সেলাই করতেন, হজরত নূহ (আঃ) ছিলেন কাঠমিস্ত্রী, এভাবে সকল নবীই ব্যবসা করতেন।

আরও পড়ুন- মহিলাদের জন্য ঘরে বসে ব্যবসা

ইসলামে ব্যবসা হালাল হওয়ার পূর্বশর্ত

ব্যবসা হালাল কিন্তু সব ব্যবসাই হালাল নয়। হালাল পণ্যের ব্যবসা হালাল উপায়ে পরিচালিত হলেই ব্যবসাটি হালাল হবে। হালাল উপার্জনের জন্য ইসলামে ব্যবসা করার নিয়ম মেনে ব্যবসা করতে হবে। এক্ষেত্রে ব্যবসা হালাল হওয়ার কিছু শর্ত উল্লেখযোগ্য –

  • অবশ্যই বৈধ পন্যের ব্যবসা করতে হবে।
  •  লাভ- লোকসানের ভিত্তিতে ব্যবসায় হতে হবে। শুধু লাভ গ্রহন সুদের নামান্তর।
  • ক্রেতা ও বিক্রেতার পন্য ও মূল্য নিয়ে সম্মতি থাকা।
  • সুনির্দিষ্ট মাপের পাত্র দ্বারা ও সঠিক ওজনে পন্য ক্রয় বিক্রয় করা।
  • অগ্রীম বা বাকিতে পন্য লেনদেন হলে শর্তাবলী তে উভয়ের সম্মতি থাকা।
  •  পন্যের সঠিক দাম নির্ধারন করা। মানুষের বিপদে পন্যের দাম বাড়ানো নৈতিক ব্যবসায়ের বিপরীত।
  • সুদ হারাম, তাই ব্যবসার সাথে সুদকে না মিশানো।
  • সুদ, জুয়া, লটারি ইত্যাদির মতো হারাম ব্যবসা না করা।
  • কারো সাথে ফাঁকি বাজি না করা।
  • মিথ্যা শপথ করে পন্য বিক্রি না করা। এটি অত্যন্ত ভয়াবহ। রাসূল (সাঃ) বলেন- ‘কেয়ামতের দিন মহান আল্লাহ তায়ালা তিন ব্যক্তির দিকে তাকাবেনও না। তাদের মধ্যে একজন হলো যে মিথ্যা শপথ করে বিক্রয় করে।’

ব্যবসা একটি স্পর্শকাতর উপার্জনের পথ। সঠিকভাবে ইসলামে ব্যবসা করার নিয়ম মেনে ব্যবসা না করলে একটি হালাল ব্যবসাও হারামে রূপান্তরিত হয়। একটি ব্যবসা হালাল হবে না হারাম তা পুরোপুরি একটি ব্যবসায়ীর উপর নির্ভর করে।

Advertisement

আরও পড়তে পারেন

ইসলামে ব্যবসা করার নিয়ম

মহান আল্লাহ তায়ালা পবিত্র কোরআনে মানব জাতির সঠিক পথ নির্দেশ করে রেখেছেন। এমন কোন বিষয় নেই যা পবিত্র গ্রন্থে নেই। আর সেই গ্রন্থে ব্যবসার নির্দেশনাও মহান আল্লাহ দিয়েছেন। এবং আমাদের প্রিয় নবী মুহাম্মদ (সাঃ) নিজে ব্যবসা করেছেন এবং ব্যবসার ক্ষেত্রে বিভিন্ন নিয়ম শিখিয়েছেন।

ইসলামে ব্যবসা করার নিয়ম হচ্ছে:

  1. হালাল বস্তু, পন্য বা সেবা ক্রয় বিক্রয় করতে হবে।
  2. পন্যের বা বস্তুর পূর্ন মালিকানা অর্জন করার পর ব্যবসা করা। রাসূল (সাঃ) এমন পন্য বিক্রি করতে নিষেধ করেছেন যা বিক্রেতার কাছে নেই। এবং আরও বলেন ” যদি কোনো ব্যক্তি পন্য ক্রয় করে, তা ততক্ষন পর্যন্ত (পূনরায়) বিক্রি করবে না যতক্ষন পর্যন্ত বস্তুটি পুরোপুরি আয়ত্তে না আসে।” (বুখারী- ২১৩৬)
  3. ক্রেতাকে পন্য উপস্থাপনে সঠিক পরামর্শ দেওয়া।
  4. ধোঁকাবাজি ও প্রতারনা করা যাবেনা। অনেক ব্যবসায়ী এক পন্য দেখিয়ে অন্য পন্য বিক্রি করে, যা ইসলামী ব্যবসার নীতিমালা বিরোধী।
  5. পন্যের সঠিক দাম নির্ধারন করে রাখতে হবে। বিশেষ করে বাকিতে পন্য বেচা-কেনা করার সময় মূল্য নির্ধারণ করে সংযোজন করতে হবে।
  6. সত্য বলে পন্য বিক্রয় করা। পন্যের মান ও গুন নিয়ে ক্রেতাকে সঠিক তথ্য দিতে হবে। মিথ্যা বলা যাবেনা।
  7. ওজনে সঠিক পরিমানে দিতে হবে। ওজনে কম দেওয়া জঘন্য অপরাধ। হজরত শোয়াইব (আঃ) এর কওম আযাব প্রাপ্ত হয়েছিলো ওজনে কম দেওয়ার জন্য।
  8.  অন্যকে না ঠকানো এবং নিজের মুনাফাও ঠিক রাখা। ক্রেতা-বিক্রেতা উভয়ের সম্মতিতে ব্যবসা করতে হবে।
  9. অনুমান ভিত্তিক ব্যবসা করা যাবেনা। এতে ব্যবসায়ের মানদণ্ড ক্ষুন্ন হয়। সঠিক দাম ও সঠিক ওজন পরিমাপ করতে হবে।
  10. কৌশল করে কখনো অন্যের মাল আত্নসাৎ করা যাবেনা। এটা হারাম। মহান আল্লাহ তায়াকা বলেন- ‘হে ইমানদার গন য়োমরা অন্যায়ভাবে কারো মাল আত্নসাৎ করো না।’
  11. বাকিতে পন্য ক্রয় করলে অবশ্যই তা লিখে রাখতে হবে।

এরকম ভাবে ইসলামে ব্যবসা করার নিয়ম সঠিকভাবে বাস্তবায়ন করে ব্যবসা করতে হবে। ব্যবসা ইসলামিক ভাবে পরিচালনা করলে আল্লাহ তায়ালা তাতে বরকত দান করবেন।

Advertisement

ইসলামে যৌথ ব্যবসা করার নিয়ম

ব্যবসার বেশ কিছু প্রকার রয়েছে। যেমন-(ক) একমালিকানা ব্যবসা, (খ) অংশীদারি ব্যবসা, (গ) যৌথ ব্যবসা, (ঘ) কোম্পানি ব্যবসা, (ঙ) সমবায় সমিতি। প্রতিটি ব্যবসার আলাদা কিছু নিয়ম রয়েছে।

আমাদের প্রিয় নবী (সাঃ) ব্যবসা করতেন এবং তিনি যৌথ ব্যবসাও করেছেন। আসুন জেনে নেই যৌথ ব্যবসার নিয়মগুলো-

  • যৌথ ব্যবসাতে দুই বা ততোধিক অংশীদার স্বেচ্ছায় তাদের অর্থ ও শ্রম দিয়ে ব্যবসাতে অংশগ্রহণ করেন। তারা ব্যবসায়ে তাদের বিনিয়োগ ও মুনাফার হার সম্পর্কে পূর্বেই একটি চুক্তি পত্র করে নিতে হবে অবশ্যই।
  • ইসলামিক ভাবে যৌথ ব্যবসাতে লাভ-লোকসানের হার বন্টন করতে হবে সঠিকভাবে। তবে শুধু লভ্যাংশের ভাগ নিলে এবং লোকসানের হার গ্রহন না করলে তা ইসলামের দৃষ্টিতে বৈধ নয়। ব্যবসাতে অবশ্যই ঝুঁকি, লাভ- ক্ষতি থাকতে হবে।
  • ব্যবসাটি ইসলামে ব্যবসা করার নিয়ম অনুযায়ী উপরোক্ত ভাবে হালাল পন্থায় হতে হবে।
  • অংশীদারদের শ্রম ও বিনিয়োগ উপর ভিত্তি করে মুনাফার হার নির্ধারণ করতে হবে। মূলধন বেশি হলে মুনাফা বেশি। এবং যে শ্রম বেশি দিবে তাকে মুনাফা বেশি দিতে হবে। কেউ শ্রম না দিলে শুধু মূলধন দিলে মুনাফা কম পাবে।

মহানবী (সাঃ) ও যৌথ ব্যবসা করেছেন। এবং পন্য বিক্রির লভ্যাংশ থেকে মুনাফা বন্টন করেছেন।

ইসলামে নিষিদ্ধ ব্যবসা

ব্যবসা সর্বোত্তম উপার্জনের পথ। তবে কিছু ব্যবসা ইসলামে নিষিদ্ধ। ইসলামে নিষিদ্ধ ব্যবসার কয়েকটি ধরন হলো-

  • হারাম পন্যের ব্যবসা করা। মদ, সিগারেট, অন্যান্য মাদকদ্রব্য, বিভিন্ন হারাম প্রানীর ব্যবসা ইসলামে হারাম। ব্যবসার মূল হচ্ছে পন্য। আর পন্য হারাম হলে ব্যবসাও হারাম।
  • সুদের ব্যবসা করা। ব্যাংকিং ব্যবসা, কিস্তি ব্যবসা, ও গ্রামীন এলাকায় পত্তন এরকম সুদভিত্তিক নানা ব্যবসা রয়েছে। অনেকে এটিকে ব্যবসা বললেও এটি ব্যবসা নয়। মহান আল্লাহ তায়ালা বলে তোমরা হালাল হারামকে একত্র করে দিওনা। বস্তুত সুদ ভিত্তিক এজাতীয় ব্যবসা হারাম ও ইসলামে নিষিদ্ধ।
  • প্রতারনামূলক ব্যবসা ইসলামে নিষিদ্ধ। অনেকেই ব্যবসার পন্য ও সেবা নিয়ে প্রতারনা করে।
  • জুয়া, লটারি ও বর্তমান সময়ের ক্রিপটোকারেন্সি জাতীয় ব্যবসা ইসলামে নিষিদ্ধ।
  • পন্যে ভেজাল মিশ্রিত করে ব্যবসা করাও ইসলামে নিষিদ্ধ। হালাল পন্যে ভেজাল মিশ্রিত করলেও তা নিষিদ্ধ বলে গন্য হবে।

ইসলাম যেটা নিষেধ করে তা থেকে বেচে থাকা মানব জাতির জন্য কল্যানকর। তাই ব্যবসা করতে হলে নীতি-নৈতিকতা ও হালাল হারাম বেছে ব্যবসা করতে হবে। ইসলামে নিষিদ্ধ ব্যবসা গুলোও মানব জাতির জন্য হুমকিস্বরূপ।

ইসলামে ব্যবসা নিয়ে প্রশ্নোত্তর (FAQ’s)

ব্যবসা কি?

মুনাফা অর্জনের উদ্দেশ্যে পন্যদ্রব্য ও সেবাকর্মকে ঘিরে উৎপাদন, ক্রয়-বিক্রয়, লেনদেন সহ সকল বৈধ অর্থনৈতিক কর্মকান্ডকে ব্যবসা বলে।

নবীদের মৌলিক পেশা কি ছিলো?

সকল নবীরাই কোন না কোন ভাবে ব্যবসা করে জীবীকা অর্জন করতেন।

ইসলামে নিষিদ্ধ ব্যবসা কি কি?

হারাম পন্যদ্রব্য, সুদভিত্তিক, প্রতারনামূলক ও ভেজাল মিশ্রিত সকল প্রকার ব্যবসাই ইসলামে হারাম বা নিষিদ্ধ।

সর্বশেষ

ব্যবসা উপার্জনের সর্বোত্তম উপায়। ব্যবসাতে লাভের কোন সীমাবদ্ধতা নেই। বিভিন্ন চাকরি ও অন্যান্য পেশায় লাভ বা উপার্জন একটা নির্দিষ্ট সীমার মধ্যে থাকে। কিন্তু ইসলামে ব্যবসা করার নিয়ম মেনে হালাল ব্যবসা করলে আপনি অনেক বেশি বরকতময় ও লাভবান ব্যবসা করতে পারবেন।

তাই আমরা সকলেই ব্যবসার উদ্যোগ নেই এবং অন্যদের ব্যবসাতে উৎসাহিত করি। চাকরি করে স্বাভাবিক জীবীকা পেলেও স্বচ্ছলতা অর্জনে ব্যবসা সর্বোত্তম।

আপনি কি হালাল ব্যবসা করেন। তাহলে কমেন্টে জানান আপনার ব্যবসা সম্পর্কে।

Similar Posts

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *